শুধু কোটি টাকার হদিশই নয়, গজরাজ গ্রুপের শিকড় বিস্তৃত বহুদূর, দাবি ইডি-র

শহর থেকে ফের মিলেছে টাকার হদিশ। ৫এ, আর্ল স্ট্রিটে বিক্রম শিকারিয়ার বাড়ি থেকে মোট ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা উদ্ধার হয়েছে বলে ইডি সূত্রে খবর। কয়লা-কাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়েই এই টাকার হদিশ পায় কেন্দ্রীয় সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে খবর, কয়লা পাচারের কালো টাকা সাদা করা হয়েছে নির্মাণ সংস্থা গজরাজ গ্রুপের মাধ্যমে। পাশাপাশি এও জানানো হয়েছে, কলকাতা জুড়ে একের পর এক প্রজেক্ট রয়েছে ওই সংস্থার।কোভিড আবহে একের পর এক নির্মাণকাজ করে এই গজরাজ গ্রুপ।

ইডি সূত্রে খবর, চূড়ান্ত গোপনীয়তা বজায় রেখেই বালিগঞ্জে নির্মাণ সংস্থা ‘গজরাজ গ্রুপ’ সংস্থার কর্ণধার বিক্রম শিকারিয়ার বাড়ি ও অফিসে হানা দেন ইডি-র আধিকারিকেরা। ফলে দিল্লি ইডি দফতরের আধিকারিকদের অভিযানের ব্যাপারে টেরই পাননি কলকাতার আধিকারিকরা। বুধবার সন্ধেয় ১০-১২ জনের দিল্লির আধিকারিকদের দল হানা দেয় বালিগঞ্জে।কারণ, কয়লা পাচারের কিংপিন লালা ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী রত্নেশ ভর্মাকে জেরা করে বেশ কিছু নির্দিষ্ট সূত্র পায় ইডি। তা থেকে এই ‘গজরাজ গ্রুপ’ সম্পর্কে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে বলে খবর।তারই ভিত্তিতে এই তল্লাশি। টাকা উদ্ধারের পাশাপাশি বেশ কিছু নথিও উদ্ধার করে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের আধিকারিকেরা। এরপরই সংস্থার মালিক বিক্রম শিকারিয়াকে বুধবার রাতভর জিজ্ঞাসাবাদ করে ইডি। তা সত্ত্বেও সদুত্তর মেলেনি বলে দাবি করা হয়েছে ইডি সূত্রে। সেই কারণেই এই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত তিনজনকে বৃহস্পতিবার ইডি দফতরে তলব করা হয়।ইডি আধিকারিকদের ধারনা, নির্মাণ সংস্থার মালিক ব্যবসায়ী বিক্রম শিকারিয়ার সঙ্গে রয়েছেন আরও একজন ধাবা মালিক। তাঁরা মূলত ‘ফ্রন্ট ম্যান’ হিসাবে কাজ করতেন।বিক্রমের ২০-৩০টা কোম্পানি রয়েছে, তার বেশিরভাগই নিজে ডিরেক্টর। বাকিগুলো পরিবারের সদস্যরা কর্ণধার। সেই কোম্পানিগুলিকে ব্যবহার করে কয়লারই কালো টাকা সাদা করা হয়েছে, অন্তত তেমনটাই মনে করছেন তদন্তকারীরা। তারই একটা অংশ বুধবার নগদে উদ্ধার করেছেন বলে দাবি ইডির। বিক্রম ও তাঁর সঙ্গীদের জেরা করে তদন্তকারীরা জানতে চাইছেন, এই টাকার উৎস কী? কোথায় বিনিয়োগ হয়েছে।

এদিকে সূত্র মারফৎ যা জানা যাচ্ছে  তাতে  গজরাজ গ্রুপের উত্থান হয়েছিল কোভিড পরিস্থিতিতে। সে সময় বাকি সমস্ত জায়গায় নির্মাণ ব্যবসার মন্দা চলছিল। কোভিডকালের মধ্যে কীভাবে গজরাজ গ্রুপ এতটা ফুলে ফেঁপে উঠল, সেটাই চলে আসে ইডি-র স্ক্যানারে।আর তখনই ইডি-র আধাকারিকেরা  খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারেন, গজরাজ গ্রুপ মূলত নির্মাণ ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ করত। বেশিরভাগ প্রজেক্টই দক্ষিণ কলকাতার। গত চার বছরে ৪২টি নির্মাণ করেছে এই গ্রুপ। পুরসভার বিল্ডিং বিভাগ থেকে এই তথ্য পাওয়া গিয়েছে।তবে পুরসভা সূত্রে খবর, কোনও বেআইনি নির্মাণ করেনি গজরাজ গ্রুপ। আইন মেনে, সব নথি সময় মতো জমা করেই নির্মাণকাজ করেছে এই সংস্থা। আরও জানা গিয়েছে, নির্মাণের প্ল্যানিং জমা পড়েছে ২০২০-২১ সালে। সেগুলো অনুমোদন পাওয়ার পর লকডাউন শেষ হতেই কাজ শুরু হয়েছে।

এখানে আরও একটা ঘটনা উল্লেখ্য। যে রত্নেশ ভার্মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ইডি এই তথ্য পায় সেই রত্নেশ কয়লা পাচারের কিংপিন লালা ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী।তিনি দীর্ঘদিন ফেরার ছিলেন। গত মাসেই তিনি আসানসোল সিবিআই আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।এরপর তাঁকে জেরা করেন সিবিআই আধিকারিকরা। যেহেতু গরু ও কয়লা পাচার মামলায় ইডি ও সিবিআই সমান্তরালভাবে তদন্ত করছে, আধিকারিকরা সেক্ষেত্রে তথ্য বিনিময় হয় দুই কেন্দ্রীয় সংস্থার আধিকারিকদের মধ্যে। এরপরই সামনে আসে বেশ কিছু নতুন সূত্র পান।এই সূত্র ধরেই ইডি-র এই ঝটিকা অভিযান। দিল্লি আধিকারিকদের এই অভিযানের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়েছে। তা না হলে নথি লোপাট হওয়ার আশঙ্কা ছিল।

এদিকে ইডি সূত্রে আরও খবর, যে সব ফাইল উদ্ধার হয় এদিন  তা থেকে তাঁরা অনুমান করছেন কয়লা কাণ্ডে জড়িত টাকা গিয়েছিল ওই ব্যবসায়ীর বাড়িতেও। নির্মাণ ব্যবসার পাশাপাশি ওই ব্যক্তির আরও একাধিক ব্যবসা রয়েছে। রয়েছে ফুড চেনের ব্যবসা, রয়েছে একটি ধাবাও। মোট তিরিশটি সংস্থা এই গ্রুপের অন্তর্গত।তবে এখন আপাতত উদ্ধার হওয়া টাকার শিকড় খুঁজতেই তৎপর তদন্তকারীরা।

সূত্রে এ খবরও মিলছে, শরৎ ঘোষ রোডের ওপরে যে ধাবাটি রয়েছে তার ঠিক পিছনেই রয়েছে একটি অতিথিশালা।সেই অতিথিশালার যিনি মালিক ছিলেন তিনি ওই ধাবার মালিক মনজিত সিং জিট্টার কাছে গত অক্টোবরে ১২ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন ওই গেস্ট হাউস।যার রেজস্ট্রেশন হচ্ছিল বুধবার। এই ১২ কোটি টাকার মধ্যে প্রায় দেড় কোটি গজরাজের অফিসে গিয়েছিল। এদিন সেই টাকাই উদ্ধার করেন তদন্তকারীরা। এদিকে এই ধাবার পিছনে থাকা অতিথিশালা ভেঙে ধাবাটির সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে যাবতীয় নির্মাণ কাজ করার কথা ছিল ওই গজরাজ গ্রুপের।

মুম্বই নিবাসী গেস্ট হাউসের সেই প্রাক্তন মালিকের বিরুদ্ধেও রয়েছে অভিযোগ। শেয়ার প্রতারণা থেকে শুরু করে আয়কর না জমা দেওয়ার একাধিক অভিযোগ রয়েছে ওই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, ওই ধাবার মালিক মনজিত সিং-এর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এই নির্মাণ ব্যবসায়ী বিক্রম শিকারিয়া। সূত্রের খবর, নিজের ধাবাকে আরও সম্প্রসারিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মনজিত সিং। ওই ধাবার মালিকের সঙ্গে শাসকদলের অনেক নেতারই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলেও জানা গিয়েছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × 4 =