সুদীপ মহাপাত্র
কাটছে বিনিদ্র রজনী। বাংলাদেশে কাটানো কালো রাতগুলো এখনও তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। চাইলেও কিছুতেই ভুলতে পারছেন না।
পলতার বাসিন্দা নীলেশ বিশ্বাস। ২০১৮ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশে ফল এবং সবজি রপ্তানি করে চলেছেন। ব্যবসা যথেষ্টই বিস্তার লাভ করেছে। সব ঠিকঠাক চললেও, ২০২২ এর শেষ প্রান্তে এসে তিনি যে এমন একটা ঘটনার সম্মুখীন হবেন তা বোধহয় দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। প্রাণে বেঁচে ফিরতে পেরেছেন নিজের মাতৃভূমিতে এটাই বোধহয় তার কাছে সবথেকে বড় পাওয়া।
ঘটনার সূত্রপাত চলতি বছরের নভেম্বর মাসে। নীলেশ বিশ্বাসের অভিযোগ, একটি কনফারেন্সের কারণে চলতি বছরের ২৯ নভেম্বর বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ বাংলাদেশের পৌঁছন ভারতের ওই ব্যবসায়ী নীলেশ বিশ্বাস। অভিযোগ, ইমিগ্রেশন এরপরে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী দুষ্কৃতী ওই ব্যবসায়ীর পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় বাংলাদেশেরই এক গ্রামে। সেখানে একটি ঘরে আটকে রেখে ওই ব্যবসায়ীর ওপর শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার চালানো হয়। সেই রাতেই সেখান থেকে বাসে করে ওই ব্যবসায়ীকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায় এবং পরে অন্য একটি জায়গায়। সেখানেও তাকে একটি ঘরে আটকে রেখে গালিগালাজ করার পাশাপাশি বন্দুক দেখিয়ে ভয় দেখানো হয় বলে অভিযোগ। সেখান থেকে বাসে করে ওই ব্যবসায়ীকে বেনাপোলে নিয়ে এসে স্থানীয় ‘মৌ হোটেল’ এ রাখা হয়। এরপরই শুরু হয় নারকীয় অত্যাচার। কিছুক্ষণ পর পর তৌসিফ আহমেদ তুহিন, ইদ্রি আল বিপ্লব, নয়ীম, বদরুল জামান, মহঃ মহিউদ্দিন, সৈয়দ রহিম মৈনুদ্দিনরা দল বেঁধে এসে ওই ব্যবসায়ীর ওপর শারীরিক নির্যাতন চালাতে থাকে। এমনকী, ওই ব্যবসায়ীকে বাড়িতে ফোন করতেও বলা হয়। তিনি রাজি না হওয়ায়, বাংলাদেশী দুষ্কৃতীরা নিজেরাই ওই ব্যবসায়ীর স্ত্রীকে বারংবার ফোন করে ২০ লক্ষ টাকা দাবি করেন এবং টাকা না দিতে পারলে তাকে সরাসরি বাংলাদেশে ডেকে পাঠানো হয়।
স্বামী বিপদে পড়েছে বুঝতে পেরে স্ত্রী কলকাতা উচ্চ আদালতের আইনজীবী ঋষিরাজ মহান্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি প্রথমে ভারতীয় অ্যাম্বাসির সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং পরে ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করে মৌ হোটেল থেকে ওই ব্যবসায়ীকে উদ্ধার করার বন্দোবস্ত করেন। উদ্ধারের পর ওই ব্যবসায়ীকে বেনাপোল থানার পুলিশের তরফে সুরক্ষা প্রদান করা হয়। কিন্তু এরপরেও হুমকি আসা বন্ধ হয়নি। বাংলাদেশ ছেড়ে গেলেও তার জীবন সংশয়ে রয়েছে এমন হুমকি দেওয়া হয় দুষ্কৃতীদের তরফে।
এত কিছুর পরে তিনি অবশেষে নিজের দেশ ভারতে ফিরে আসেন। কিন্তু বাংলাদেশে তার ওপর হওয়া নির্মম অত্যাচারের ‘কালো রাত’ এখনও তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এখনো আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারেননি ব্যবসায়ী এবং তার পরিবার।
এ বিষয়ে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা ওই ব্যবসায়ী সাহায্যের আবেদন জানালে এবং অভিযোগ পেলে পুলিশের তরফে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে।
ওই ব্যবসায়ীর আইনজীবী ঋষিরাজ মহান্তি জানিয়েছেন, ২০১৮ সাল থেকে ব্যবসায়ীক লেনদেন চললেও, গোল বাধে ২০২২ এ। হিন্দু হয়েও কেন বাংলাদেশে ওই ব্যবসায়ী ব্যবসা করতে গেছেন তা থেকেই মূলত ঘটনার সূত্রপাত।
উল্লেখ্য, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে, এমন তিন রাজ্যে ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বা বিএসএফ-এর। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নয়া নির্দেশিকা অনুযায়ী, পঞ্জাব, অসম এবং পশ্চিমবঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে ভারতীয় ভূখণ্ডে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় বিএসএফ গ্রেপ্তার, তল্লাশি এবং বাজেয়াপ্ত করার কাজ করতে পারবে। সেক্ষেত্রে এই ঘটনায় বিএসএফ-এর ভূমিকা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। ব্যবসায়ীকে উদ্ধারের পরেও নিয়মিত প্রাণে মারার হুমকি আসতে থাকার ঘটনায় বাংলাদেশ পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। যেখানে, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটাই ভারতীয় পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। সেখানে এই ঘটনা ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য সম্পর্কে কতটা প্রভাব ফেলবে সেটা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে ওয়াকিবহাল মহলে। নিজের দেশে ফিরলেও, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি তিনি। ভালো নেই তার পরিবার। আর্জি একটাই, পাশে থাকুক সরকার।