লক্ষ্মী নয়, ঘর আলো করে থাকুক ‘সরস্বতী’রা

কথায় আছে ‘রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী’। কিন্তু এক্ষেত্রে বিষয়টা এরকম ‘শুধু নামে নয়, গুণেও সরস্বতী’। দুর্গাপুরের কোক-ওভেন থানার অন্তর্গত দেশবন্ধু কলোনী। সেখানেই টিনের চালের ছোট্ট বাড়িতে সরস্বতী রজক ওরফে মাহির বেড়ে ওঠা। পরিবারের সদস্য বলতে মা, বাবা, দাদা আর মাহি। অভাবের সংসার, দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগার করতেই সরস্বতীর বাবাকে হিমসিম খেতে হয়। সেখানে পড়াশোনা যেন একপ্রকার বিলাসিতাই। কিন্তু, ওই যে বলে ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। আর সেই কথাটা যে কতখানি সত্যি, তা নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে দিল সরস্বতী। দুর্গাপুর টু দিল্লি এইমস, না যাত্রাটা মোটেই সহজ ছিল না। তাই এদিন কথাগুলো বলতে গিয়ে সরস্বতীর গলা ধরে এল। চোখের জল মুছতে মুছতে বললো, দিদা তার খুব প্রিয় ছিলেন। বছর সাতেক আগের ঘটনা। দিদা অসুস্থ, মৃত্যুশয্যায় লড়াই করছেন। কিন্তু, টাকা ছিল না তাই বাধ্য হয়ে সেদিন হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে আনতে হয়েছিল দিদাকে। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় সরস্বতীর দিদার। আর দিদার এই মৃত্যুই সরস্বতী রজকের জীবনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’ ছিল। তখন থেকেই চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখে সরস্বতী। বিনামূল্যে দুঃস্থদের চিকিৎসা পরিষেবা দিতে চায় সে। বিনা চিকিৎসায় এভাবে কারোর মৃত্যু না হোক, চিকিৎসক হয়ে দুঃস্থদের পাশে দাঁড়ানোই সরস্বতীর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্যকে স্থির করেই, সাফল্যের শিখরে আজ দুর্গাপুরের সরস্বতী। বাড়িতে জানিয়েছিল, সে চিকিৎসক হতে চায়। বাবা সাইকেল নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে গ্যাস সিলিন্ডার রিপেয়ারিংয়ের কাজ করেন। তাতে যা রোজগার হয় তা দিয়ে সংসার টানাই কঠিন। তাও, সরস্বতীর বাবা-মা কখনো তাকে নিরাশ করেননি। মেয়ের ইচ্ছেতেই সায় ছিল বাবা-মায়ের। বলেছিলেন হ্যাঁ, তুই ডাক্তারিই পড়বি। বাবা বইও কিনে দিতে পারেননি মেয়েকে। টিউশন ছিল না, করেনি কোনো কোচিং ক্লাস। একটা সময়, সন্তানের যন্ত্রণা বুঝতে পেরে গুমরে গুমরে কাঁদতেন বাবা মা। কিন্তু, তখনও ভেঙে পড়েনি সরস্বতী। বরং সেই তার বাবা মাকে সাহস জুগিয়েছে। বলেছিল, চিন্তা করোনা, সরকারি খরচে পড়াশোনা করে আমি ডাক্তার হব। আর সেই লক্ষেই দিন রাত এক করে পড়াশোনা করত সরস্বতী। জীবনের প্রথম শুরুটা শিশুশিক্ষা কেন্দ্র থেকে। তারপর সাগড়ভাঙা উচ্চ বিদ্যালয়, দুর্গাপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, রানিগঞ্জের টিডিবি কলেজ। না, কোনো ইংরেজি মাধ্যম নয়। বাংলা মাধ্যম থেকে পড়াশোনা করেও যে এই জায়গায় পৌঁছনো সম্ভব, তা প্রমাণ করে দিয়েছে সে। আর এত কঠিন লড়াইয়ের পর অবশেষে এল সেই প্রত্যাশিত সাফল্য। সরস্বতী রজক নিট পরীক্ষায় ৬০০০ র‌্যাঙ্ক করেছিল। তারপর কলকাতা সহ বেঙ্গালুরুর বিভিন্ন জায়গায় সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু, সরস্বতীর মনে হয়েছিল দিল্লির এইমসে পড়াশোনা করা সে ‘ডিজার্ভ’ করে। তাই, এইমসে পরীক্ষা দিয়ে পরপর তিনটি ধাপে উত্তীর্ণ হয়ে আজ ডাক্তারি পরীক্ষায় সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে প্রথম স্থান অর্জন করেছে সরস্বতী রজক। সরস্বতী ওরফে মাহি এখন শহরের ‘নয়নের মণি’। তবে সরস্বতী কথায়, এই সম্পূর্ণ কৃতিত্ব তার পরিবারের। এমন সরস্বতীদের উঠে আসতে হলে আমার মা-বাবা-দাদাদের মতো পরিবারে অন্তত একজন সদস্য থাকা জরুরী বলল সরস্বতী। তার আরও সংযোজন, সিপিআইএম নেতা পঙ্কজ রায় সরকার তাকে এই জায়গায় পৌঁছে দিতে অনেকটাই সাহায্য করেছেন। কিন্তু, এরপর কিভাবে চলবে? আনন্দের মাঝেও সরস্বতীর মায়ের মন থেকে চিন্তার মেঘ কাটছে না। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, মেয়ে রাত জেগে পড়ত। ওর চোখ দিয়ে যেন জল নয়, রক্ত পড়ত। এতটা তো এল, কিন্তু এরপর কি হবে? যদিও, সরস্বতী অনগ্রসর তপশিলি জাতি ও উপজাতি সম্প্রদায়র্ভুক্ত হওয়ায় তার পড়াশোনার দায়ভার বহন করবে এইমস। এমনকী, এইমসের ডাক্তারি পরীক্ষায় সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে প্রথম স্থান অধিকার করার সুবাদে ৩ মাস অন্তর অন্তর ৫০ হাজার টাকা করে বৃত্তি পাবে সরস্বতী। খুশি সরস্বতীর বাবা। নিজের চেষ্টায় মেয়ে এই জায়গায় এসেছে, আমি খুব খুশি হয়েছি। গর্ববোধ হচ্ছে, বললেন নিত্যানন্দ রজক। অভাবের সঙ্গে লড়াই, ইচ্ছে থাকলেই উপায়..এসব কথা বলা যত সহজ। কাজে করা ততটা নয়। তবুও অভাবের অন্ধকার গলি থেকে আজ রাজপথে পৌঁছে গিয়েছে মাহি। সাফল্য এসেছে ঘরে। কে চায় হাতা-খুন্তি নেড়ে হেঁসেলে ঠাঁই পাওয়া লক্ষ্মীদের? সময় বদলেছে। বরং ঘরে ঘরে জন্ম হোক এমন সরস্বতীদের। যাদের জন্য মুখ উজ্জ্বল হয় বাবা মায়ের, যাদের জীবনের স্বপ্নের উড়ান সব গণ্ডি ছাড়িয়ে পাড়ি দেয় অনেক-অনেক দূরে..।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × 3 =