১০ টাকায় ভরবে পেট, এসএসকেএমের সামনে ‘মা অন্নপূর্ণা ঘুগনি’ গরিবের কাছে অন্নপূর্ণার ভাণ্ডার

কলকাতা: ভোর থাকতেই ঘুম থেকে ওঠা। তারপর বিশাল কড়াইতে ঘুগনি বানানোর তোড়জোড়। দিনের আলো ফুটতেই সাইকেলে হাঁড়ি চাপিয়ে বাড়ি থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া। সাইকেল চালিয়ে সোজা কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালের সামনে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা একই রুটিন সোনারপুরের বাসিন্দা মহাদেব মণ্ডলের।

না তিনি হাসপাতালে কর্মী নন। বরং হাসপাতালে আসা সমস্ত গরিব মানুষের পেট ভরানোর অলিখিত ঠেকা নিয়ে রেখেছন তিনি, স্বেচ্ছায়। তাঁর অন্নপূর্ণা ঘুগনি যেন সত্যিই মা অন্নপূর্ণার ভাণ্ডার।

নাম মহাদেব হলেও, তিনি এসএসকেএম হাসপাতাল চত্বরে ঘুগনি কাকু নামেই পরিচিত। এই সহৃদয় মানুষটি প্রতিদিন ২ ঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে সোনারপুর থেকে আসেন এসএসকেএম হাসপাতালের সামনে। সারাদিন বিক্রি করেন ঘুগনি।

অনেকেই ভাবতে পারেন এতে আশ্চর্যের কী আছে? দুপয়সা রোজগারের জন্য এমন তো কত লোকেই করে! আসলে এই ঘুগনি দিয়েই হাসপাতালে আসা অসহায়, গরিব রোগীর আত্মীয় পরিজনদের পেট ভরিয়ে আসছেন মহাদেব।

দাম মাত্র ১০ টাকা, তবে অফুরন্ত ঘুগনি। অর্থাৎ , যতক্ষণ না পেট ভরছে ততক্ষণ মিলবে ঘুগনি। তবে নষ্ট করা বারণ।যদিও বয়স্ক ও শিশুদের থেকে এক পয়সাও নেন না তিনি। দেবাদিদেব মহাদেবের ঘরণী মা অন্নপূর্ণার নামেই সার্থক নাম রেখেছেন তাঁর ঘুগনির। ‘মা অন্নপূর্ণা ঘুগনি’।

মহাদেব মণ্ডলের কথায় রাত ২ টো নাগাদ ঘুগনি তৈরি করে হাঁড়িতে ভরেন। এরপর বাড়িতে মা অন্নপূর্ণাকে পুজো দিয়ে পৌনে চারটে নাগাদ হাঁড়ি ভর্তি ঘুগনি   নিজের সাইকেলে চাপিয়ে সোনারপুর থেকে হাসপাতালের সামনে চলে আসেন। এখানে ভর্তি হওয়া রোগীদের আত্মীয়, পরিজনদের দশ টাকাতে পেট ভরা ঘুগনি খাওয়ান তিনি। যার যত ইচ্ছা হয় খায়। যাদের পয়সা দেওয়ার ক্ষমতা নেই তাঁদেরকেও জেনেই ঘুগনি খাওয়ান। তবে ঘুগনি নষ্ট করলে তিনি রাগ করেন, মনে ব্যাথা পান। ওই নষ্ট হওয়া ঘুগনি দিয়ে তো আরেকজনের পেট ভরানো যেত এমনটাই দাবি করেন মহাদেব মণ্ডল।

মহাদেবের কথায়, মা অন্নপূর্ণার নাম করেই হাঁড়িতে লাল কাপড় বেঁধে রেখেছেন তিনি। আর হাঁড়ি থেকে শেষবারের জন্য ঘুগনি তোলার সময়েও তা যথেষ্ট গরম থাকে। কোনো স্টোভ বা উনুন তার নেই। হয়তো এটাই মায়ের আশীর্বাদ। তাই এতো বছর ধরে কোনওদিন কখনও কেউ তাঁর কাছে এসে ঘুগনি শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য ফেরৎ যায়নি। কোভিডের সময়েও এভাবেই তিনি রোজ এসে ঘুগনি খাইয়েছেন হাসপাতালে আসা রোগীদের আত্মীয় ও পথ চলতি মানুষদের। তবে তিনি জানান, ১০ টাকা তিনি নেন তবে কেউ চাইলে দশ পাতাও খেতে পারেন। এছাড়াও তাঁর কাছে কোনও বয়স্ক ও বাচ্চা খেতে এলে তাঁদের বিনামূল্যেই খাওয়ান।

রাস্তা ঘাটে অনেকেরই গন্তব্যে যাওয়ার সময় দুর্ভাগ্যবশত টাকা পয়সা হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায়।  আর সেরকম কেউ তাঁর কাছে আসলে তাঁকে পেট ভরে ঘুগনি খাইয়ে মা অন্নপূর্ণার নাম করে হাতে ৫০ টাকা দেন বাড়ি যাওয়ার জন্য। এভাবেই এত বছর ধরে জীবন কাটাচ্ছেন সোনারপুরের মহাদেব মণ্ডল। জানালেন, লাভ করতে ব্যবসা খোলেননি। সকলকে মায়ের দয়াতে পেট ভরে খাওয়াতে পারছেন আর নিজেরও অন্ন সংস্থান হয়ে যাচ্ছে এটাই অনেক বড় কথা।

তার একটাই কথা ‘বিন্দু বিন্দু সঞ্চয় করে যেতে হবে। সেটাই একদিন শক্ত গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে। পিছিয়ে পরা বা থেমে যাওয়া নয় এগিয়ে যেতে হবে এটাই জীবন’।

ছেঁড়া ফাটা মলিন জামা গায়ে মা অন্নপূর্ণার আশীর্বাদে অফুরান জীবনী শক্তিতে ভরপুর হয়ে অসহায় মানুষের জন্য  ‘মা অন্নপূর্ণা ঘুগনি’ যেন স্বয়ং মা অন্নপূর্ণাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × 5 =